বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৬ অপরাহ্ন
তরফ নিউজ ডেস্ক: সিলেটের ১২৮ বছরের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুরারিচাঁদ কলেজ (এমসি) ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে তরুণী গৃহবধূকে গণধর্ষণের পেছনে মূলত হোস্টেল সুপার ও প্রহরীদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে ওই কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদও কোনোভাবে এই ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।
দেশে-বিদেশে আলোচিত এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের কার কী দায়, সে বিষয়ে অনুসন্ধানে হাইকোর্ট কর্তৃক গঠন করে দেয়া বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অংশের মতামতে এসব কথা বলা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার সময় কলেজ বন্ধ থাকার পরও কয়েকজন ছাত্র ও প্রাক্তন ছাত্র হোস্টেলে অবস্থান করেন। একজন প্রাক্তন ছাত্র ৫ নম্বর ব্লকের হোস্টেল সুপারের বাসভবন দখল করে থাকেন। প্রাক্তন ওই ছাত্ররা অবৈধভাবে কলেজে হোস্টেলের সিট দখল করে থাকা এবং প্রাক্তন ছাত্র সাইফুর রহমান কর্তৃক হোস্টেল সুপারের বাসভবন জোর করে দখল করে থাকার কারণেই তারা কলেজের হোস্টেল এলাকায় গণধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করার সাহস পান।
ফলে ঘটনার দিন হোস্টেল ক্যাম্পাসে ওই ঘটনার নেপথ্যে মূলত হোস্টেল সুপারদের তদারকির ঘাটতি ও দায়িত্বে অবহেলাই দায়ী। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে কলেজের অধ্যক্ষের ওপরও এ দায়ভার চলে আসে।
চার সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ মো. বজলুর রহমান, অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মমিনুন নেসা, মুখ্য মহানগর বিচারিক হাকিম মো. আবুল কাশেম ও সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শারমিন সুলতানা।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ হয়, সাক্ষী, পরীক্ষা ও সামগ্রিক বক্তব্য পর্যালোচনা করে কমিটির সর্বসম্মত মতামত হলো, গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের পেছনে মূলত হোস্টেলের বর্তমান তত্ত্বাবধায়করা, হোস্টেলের মূল গেটের ডে গার্ড, ৫ নম্বর ব্লকের ডে গার্ড ও নাইট গার্ড (নৈশপ্রহরী) এবং ৭ নম্বর ব্লকের ডে গার্ড ও নাইট গার্ডের দায়িত্বে অবহেলা ছিল।
এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য ১৫ দফা সুপারিশ করেছে চার সদস্যের ওই কমিটি। যেখানে কলেজের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের চাহিদার ভিত্তিতে হোস্টেলে আসন নিশ্চিত করা এবং অছাত্র বা প্রাক্তন ছাত্রদের হোস্টেলে বসবাস কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে আগামী ২৮ জানুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে।
গণধর্ষণের ওই ঘটনার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর গত সেপ্টেম্বরে আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ মিসবাহ উদ্দিন। শুনানি নিয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়ার নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন।
এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষের অবহেলা নিরূপণে চার সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়ে তা অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দেয়া হয়। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। গত ২০ অক্টোবর ওই কমিটি আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, একজন শিক্ষককে একাধিক হোস্টেলের দায়িত্ব দেয়ার পরিবর্তে একক দায়িত্ব দিতে হবে, হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়কদের দায়দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে, কলেজের হোস্টেলগুলোতে বহিরাগত প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, হোস্টেলের মূল গেটে এবং প্রতিটি ব্লকের পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) ব্যবস্থা করতে হবে, হোস্টেলের যেসব স্থানে সীমানাপ্রাচীর নেই, সেসব স্থানে সুউচ্চ দেয়াল নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে, পুরো হোস্টেল এলাকায় প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ভেতরে একটি রাস্তায় স্বামীকে আটকে প্রাইভেটকারের ভেতর ওই গৃববধূকে (২৫) পালাক্রমে গণধর্ষণ করেন ছাত্রলীগের ৬ নেতাকর্মী। ঘটনার রাতেই নির্যাতনের শিকার ওই নারীর স্বামী বাদী হয়ে শাহপরান থানায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন।
পরবর্তীতে ৬ আসামিসহ সন্দেহভাজন আরও দুজনকে গ্রেফতার করে র্যাব ও পুলিশ। গ্রেফতার হওয়া আটজনই মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
মামলাটি তদন্ত করে গত ৩ ডিসেম্বর গ্রেফতার ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্তনীল ভট্টাচার্য। এ মামলায় মোট সাক্ষী করা হয়েছে ৫২ জনকে।
অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজনকে সরাসরি ধর্ষণে সম্পৃক্ত এবং রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুমকে ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই আটজনই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে ধর্ষণের অভিযোগে দাখিলকৃত চার্জশিটসহ মামলাটি গত ৩ ডিসেম্বর বিভাগীয় নারী ও শিশু নির্যতন দমন ট্রাইব্যুনালে এবং গত ২৭ ডিসেম্বর চাঁদাবাজি ও মারপিটের অভিযোগের মামলাটি সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য বদলি করেন সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম (দ্বিতীয়) আদালতের বিচারক সাইফুর রহমান।
অস্ত্র আইনের মামলাটির অভিযোগপত্র (চার্জশিট) পর্যালোচনার জন্য মুখ্য মহানগর হাকিম (দ্বিতীয়) আদালতে রাখা হয়েছে বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে।
এরমধ্যে গত ১৭ জানুয়ারি গণধর্ষণ মামলায় আট ছাত্রলীগকর্মীকে অভিযুক্ত করে অভিযোগ গঠন (চার্জ গঠন) করেন বিভাগীয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। বুধবার (২৭ জানুয়ারি) এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য রয়েছে।